পরীক্ষা
– সুদীপা ধর
অনিমেষ আর সুচেতা কলেজের বেস্ট ফ্রেন্ড। মারাত্মক বন্ধুত্ব তাদের দুইজনের মধ্যে, দুজনে যেন একে অপরকে ছাড়া চলার কথা ভাবতেও পারে না। লিটারেচারের ছাত্রী সুচেতা আর বিজ্ঞানের ছাত্র অনিমেষ। তাদের কবিতাপাঠ যেন নেশা ছিল। কলেজের অফ টাইমে তারা যে কত কবিতা পাঠ করতো তার কোনো হিসাব ছিল না। সেই সময়টা অনেকেই ভিড় করে ঘিরে ধরে তাদের কবিতা পাঠ করা শুনতো। দুজনেই ভীষণ সুন্দর আবৃত্তি করতো। অদ্ভুত মায়াময় কন্ঠ ছিল দুজনের। তারা একসাথে অনেক স্টেজ শো করেছ।
এদের প্রেমটাকে অনেকেই বুঝতো না। অনেকেই ভাবতো কবিতার প্রতি প্রেম নাকি সত্যি এদের মধ্যে কোন আত্মিক যোগ আছে। আবার কেউ কেউ এদের ‘অর্ধনারীশ্বর’ আখ্যায় ভূষিত করেছিল। এই ভাবেই বেশ মধুর দিনগুলো মধুর সম্পর্কের ভালোলাগার মধ্যে কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যে ঘটনা হয়তো ঘটার দরকার ছিল না। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে ঘটে সত্য। এ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
কলেজ জীবনের শেষ দিনে হঠাৎই অনিমেষ এক প্রস্তাব রাখলো সুচেতার কাছে। প্রস্তাবটা এই যে, আমরা কি সত্যিই দুজন দুজনের জন্য সৃষ্টি হয়েছি, আমরা কি সত্যই একে অপরকে ছাড়া দিনযাপন করতে পারবো না। এমন অদ্ভুতুড়ে ভয়াবহ প্রস্তাবে সুচেতা বাক্যহারা- যেমন সুর না থাকলে বাঁশি সংগীতহারা হয় ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছে সুচেতার। এর পরের প্রস্তাবটি আরো ভয়াবহ। আমাদের ভালোবাসার পরীক্ষাতে আমরা ছয় বছর দেখা করবো না একে অপরের সঙ্গে। আমাদের বুঝতে হবে আমরা একে অপরের অভ্যাস নাকি সত্যিই আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।
রাজি হয় না সুচেতা এই প্রস্তাবে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে যেমন চারিদিক লন্ডভন্ড হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে তার মনের ভিতর খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষকে বোঝানো বৃথা তাও জানে সুচেতা। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছে তার হৃদয়ের ভূমিকম্পের কথা, ঝড়ের কথা। বুঝতে পারছে, বুঝতে কি সত্যিই পারছে? না..বুঝছে না। তার জেদের কাছে হারলো সুচেতা। ঠিক হয়েছিল ছ বছর বাদে ঠিক এই কলেজের সামনে ফুল নিয়ে হাজির হবে দুজনে যদি সত্যি ভালোবাসা থাকে। আর যে আসবে না শুধুমাত্র ভালো বন্ধুত্বের খাতিরে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হবে, শুধুমাত্র কেমন আছে তা দেখার জন্য।
এইভাবে কালের গতিতে একের পর এক বছর কেটে যেতে লাগলো। সেই দিনটা সত্যিই এল। অনিমেষ হাজির একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে। যেটা সুচেতার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়াবার পরেও যখন সুচেতা এলো না, তখন হাজারটা প্রশ্ন অনিমেষের মনে ভিড় করতে থাকে। নিজেই নিজের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন-উত্তর তৈরী করতে থাকে মনের ভিতর। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় ছ বছর আগে এই অদ্ভুত প্রস্তাব রাখার জন্য। কারণ সুচেতা বারবার তাকে বারণ করেছিল, কিন্তু সে শোনেনি। হয়তো সুচেতা রাগ করেই তার সাথে দেখা করতে আসেনি। অনিমেষ জানে বড় অভিমানী মেয়ে এই সুচেতা। অনিমেষকে এই রাগ ভাঙ্গাতে হবে। আহত মন নিয়ে কথা মত ইঞ্জিনিয়ার তরুণ-যুবক অনিমেষ একেবারে সুচেতার দোরগোড়ায় হাজির।
সুচেতার বাবাই খুলেছিল দরজাটা। ভিতরে ঢোকার পর অনিমেষের মনে হতে লাগলো কোথাও যেন কিছু ঠিক নেই। সুচেতার বাবাই প্রথম কথা বলল, তুমি বুঝি অনিমেষ। গুরুগম্ভীর স্বরটি শুনতে পেয়ে অনিমেষ ‘হ্যাঁ’ বললো। চোখের জলের দু’ ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে নামতে নামতে নিয়তির পরিহাসের শিকার অভাগা পিতা জানালেন, আজ থেকে একবছর আগেই চলে গেছে সুচেতা। ধরে রাখতে পারলাম না বাবা, ভেবেছিলাম তোমার কাছে যাবো, গিয়ে ওর অসুস্থতার কথা বলবো, কিন্তু সুচেতা কিছুতেই তোমার কাছে যেতে দেয়নি। কি সব শর্তের কথা বলেছিল সে। আমার হাসি খুশি মেয়েটা তোমার নিছক খেলাখেলা শর্তের মুর্খামির জন্য চির বিদায় নিল। ভালোবাসার পরীক্ষা কি এমন ভাবে হয় অনিমেষ। শুধু একটি চিঠি রেখে গেছে তোমার জন্য। ও হয়তো জানতো তুমি আসবে। তাই বলে গিয়েছিল এলে যেন তোমাকে দি।
অনিমেষের মনে হতে লাগল চারিদিকে যেন ভুমিকম্প হচ্ছে। সুচেতা মিষ্টি হাতের লেখাটা চোখের জলে যেন ঝাপসা হয়ে গেল- ‘খুব কি দরকার ছিল পরীক্ষা নেওয়ার, আমাদের আত্মিক যোগ হয়তো তুমি বোঝোনি, বুঝেছিলাম আমি। আমি খুব জানতাম এক আত্মা কিছুতেই থাকতে পারবেনা আর এক আত্মাকে ছেড়ে। আমি জানতাম তুমি আসবে, কিন্তু তোমার ছেড়ে চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি, ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো আর থাকা হলো না। তুমি ভালো থেকো।’
এক একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত বোধহয় শত মাথা খুঁড়ে, নিজের জীবনকে ঘৃণা করে, নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, বোধহয় হয়না। সুচেতা হয়তো তার আর অনিমেষের ভালোবাসার পরীক্ষা এই ভাবেই দিয়ে গেল।
Lekhata khube bhalo hoeche.
কি সুন্দর লিখেছেন,
Bhison sundor, mon bhore gelo. Khub touchy ..chaliye jao bondhu